আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কখনোই কাজ করার সুযোগ দেবে না বাংলাদেশ। কেননা, বাইরে কাজ করার সুযোগ মিললে রোহিঙ্গা বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে মিশে যাবে এবং প্রত্যাবাসনসহ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সেজন্য জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাকে (ইউএনএইচসিআর) রোহিঙ্গাদের অর্থায়নে জোর দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যাবাসন ইস্যুতে রাখাইনে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
রোববার (৪ জুন) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ সফররত ইউএনএইচসিআরের উপ-হাইকমিশনার কেলি টিক্লেমেন্টস। বৈঠকে ঢাকার পক্ষ থেকে ইউএনএইচসিআরকে এসব বার্তা দেওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো।
# নিরাপত্তা ও প্রত্যাবাসন ইস্যুতে রোহিঙ্গাদের বাইরে কাজের সুযোগ নয়
# রাখাইনে সহায়ক ও নিরাপদ পরিবেশ এবং রোহিঙ্গাদের অর্থায়নে জোর
# প্রত্যাবাসন নিয়ে দিনক্ষণ চূড়ান্ত নয়
# রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হলে শুরু হবে প্রত্যাবাসন
# চীনে আস্থা রাখছে বাংলাদেশ
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইউএনএইচসিআরের উপ-হাইকমিশনারকে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। উপ-হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চেয়েছে। ঢাকার পক্ষ থেকে কেলিকে জানানো হয়েছে, প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করা হয়নি। আর প্রত্যাবাসন শুরু হলে সেটা অবশ্যই রোহিঙ্গাদের জানিয়ে করা হবে, জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না।
ঢাকার স্পষ্ট বার্তা, রোহিঙ্গা শিশুদের মিয়ানমারের কারিকুলামের বাইরে পাঠদানের সুযোগ দেওয়া হবে না। পাশাপাশি কাজের জন্য রোহিঙ্গাদের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে ইউএনএইচসিআরের উপ-হাইকমিশনার কেলি টিক্লেমেন্টস
ইউএনএইচসিআরকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার আগেই যদি বলা হয়, রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি তবে প্রত্যাবাসন শুরু করা কঠিন হয়ে পড়বে। ঢাকার পক্ষ থেকে গত কয়েক বছরে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি সংশ্লিষ্টরা বার্তা দিয়ে আসছেন, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে- মিয়ানমারে গণতন্ত্র নেই কিংবা রাখাইনের পরিবেশ এখনও প্রত্যাবাসনের অনুকূলে না, এর চেয়েও জরুরি হচ্ছে ইউএনএইচসিআরসহ জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টদের রাখাইনে মনোযোগ দিতে হবে এবং দাতাদের কাছ থেকে অর্থায়ন জোগাড় করায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রে আরও জানা যায়, বৈঠকে রোহিঙ্গাদের অর্থায়ন কমে যাওয়ার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে প্রতি বছর রোহিঙ্গাদের জন্য দাতাদের অর্থায়ন কমে যাওয়ার বিষয়টি তুলে অর্থ জোগাড়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে ইউএনএইচসিআরকে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
চলতি মাসে রোহিঙ্গাদের রেশন জনপ্রতি মাসিক ১০ ডলার থেকে কমিয়ে ৮ ডলারে নিয়ে আসার বিষয়টি ওঠে এসেছে। এক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআরকে স্পষ্ট বার্তায় ঢাকা জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কখনোই কাজ করার সুযোগ দেবে না বাংলাদেশ। কেননা, বাইরে কাজ করার সুযোগ মিললে রোহিঙ্গা বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে মিশে যাবে এবং প্রত্যাবাসনসহ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের কারিকুলামে রোহিঙ্গা শিশুদের পাঠদানের বাইরে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজের সুযোগ দিতে জাতিসংঘসহ দাতাদের চাপ রয়েছে। কিন্তু ঢাকার স্পষ্ট বার্তা, রোহিঙ্গা শিশুদের মিয়ানমারের কারিকুলামের বাইরে পাঠদানের সুযোগ দেওয়া হবে না। পাশাপাশি কাজের জন্য রোহিঙ্গাদের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় এসেছে। রোহিঙ্গাদের অর্থায়নে কমে আসছে। এ বিষয়ে ইউএনএইচসিআর দু:খ প্রকাশ করেছে। প্রত্যাবাসন ইস্যু এসেছে। আমাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখনও প্রত্যাবাসন নিয়ে তারিখ ঠিক হয়নি। রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হলে প্রত্যাবাসন শুরু হবে, তাদের না জানিয়ে পাঠানো হবে না। আর রোহিঙ্গারা রাজি হলেই প্রত্যাবাসন হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের কারিকুলামে পাঠদানের বিষয়টি বলা হয়েছে, স্কিল ডেভলাপমেন্টের কথা এসেছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেসব কাজ করছে সেটা তাদেরকে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী
ইউএনএইচসিআরকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত গিয়ে যেন কাজ করতে পারে, সেজন্য আমাদের কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে।
দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়টি সামনে আসলে মিয়ানমারের সহায়ক পরিবেশ নিয়ে কথা ওঠে। কিন্তু গত কয়েক বছরে কখনও সহায়ক পরিবেশ হয়েছে, এমনটা শুনিনি। সহায়ক পরিবেশ কখনও মিয়ানমারে ছিল না। এটা বলে কোনো লাভ নাই। যখন রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হবে তখন প্রত্যাবাসন হবে। জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্টদের উচিত মিয়ানমারে এনগেজমেন্ট বাড়ানো, রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগী হওয়া।
কূটনীতিক সূত্রগুলো বলছে, ইউএনএইচসিআরের উপ-হাইকমিশনার কেলি একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে জাপান হয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। মূলত, রোহিঙ্গাদের অর্থায়নের টাকা জোগাড় করতে টোকিও সফর করেছেন ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিদল।
চীনের উদ্যোগের অগ্রগতি জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে চীন প্রত্যাবাসন শুরু করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। মিয়ানমারও রাজি আছে। এখনও চূড়ান্ত তারিখ হয়নি। রোহিঙ্গারা রাজি হলে সবার সম্মতিতে একটা তারিখ ঠিক করা যেতে পারে।
চীনের ভূমিকায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। ওই সময় রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানায় রোহিঙ্গারা। ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে তারা। এরপর প্রায় ছয় বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
চলতি বছর নতুন করে আবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে বেশ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছে চীন। তারই অংশ হিসেবে এপ্রিলের মাঝামাঝিতে চীনের কুনমিং-এ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে বৈঠক করেছে চীন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় রোহিঙ্গাদের একটি দল নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রাখাইন সফর করবেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা রাখাইন ঘুরে আসে। ফিরতি সফরে রোহিঙ্গাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সফরটি পিছিয়ে যায়। পরবর্তীতে গত ২৫ মে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজার এসে ঘুরে গেছেন।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে বেশ আগ্রহী মিয়ানমার। অতীত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে প্রত্যাবাসন শুরুতে বাংলাদেশের ভরসা আছে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার রাজি আছে। ভরসা বিষয়টি নিয়ে এখন কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে যেহেতু প্রত্যাবাসনের সঙ্গে চীন যুক্ত, অন্তত তাদের বিষয়টি বলা যাবে। চীন ছাড়া অন্য বন্ধু রাষ্ট্ররা এগিয়ে আসছে না। সুত্র: ঢাকাপোষ্ট
পাঠকের মতামত